কুষ্টিয়ায় আজও ঘাতক ড্রাম ট্রাক কেড়ে নিল এক শিশুর প্রাণ
প্রশাসনের নাকের ডগায় শহরের মধ্যে বেপরোয়া গতিতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে প্রায় ৫শ’র ও বেশি ড্রাম ট্রাক
কে এম শাহীন রেজা , কুষ্টিয়া জেলা প্রতিনিধি।।
কুষ্টিয়ায় বেপরোয়া বালিবাহী ড্রাম ট্রাক কেড়ে নিল ৭ বছরের শিশুর তরতাজা প্রাণ। এসময় ঘাতক ড্রাম ট্রাক চালক কে আটক করেছে পুলিশ। জানা যায়, আজ ১৪ ডিসেম্বর শুক্রবার বিকেল সাড়ে চারটায় শহরের লাহিনী বটতলা শাহপাড়া এলাকায় ড্রাম ট্রাকের ধাক্কায় অনিক (৭) নামের শিশু গুরুতর আহত হওয়ার পরপরই ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। প্রায় দুই ঘণ্টা মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে অবশেষে সন্ধা সাড়ে ৬ টার দিকে না ফেরার দেশে গেল শিশুটি ।
এলাকবাসী জানায়, ড্রাম ট্রাকটি শিশু অনিক কে ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে এলাকাবাসী ট্রাকটি আটক করে চালককে গণধোলাই দেয় এবং ট্রাকটিতে ভাংচুর চালায়। পরে এস আই খালিদুর রহমান আশিক, এসআই সাহেব আলী ও এএসআই আসাদ ঘাতক ড্রাম ট্রাক চালক কে আটক করে কুষ্টিয়া মডেল থানায় পাঠায় এবং ড্রাম ট্রাকটি আটক করে মিলপাড়া পুলিশ ফাঁড়িতে রাখা হয়েছে। এবিষয়ে কুষ্টিয়া মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ সাব্বিরুল আলম সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করে পাওয়া যায়নি। নিহত শিশু অনিক শহরের লাহিনী বটতলা এলাকার আক্কার শাহ এর ছেলে। শুধু আক্কার সাহের ছেলেই প্রাণ হারায়নি, বছরের শুরুতেই গত কয়েকদিনেই বালুবাহী ট্রাকের চাকায় প্রাণ দিতে হয়েছে নারীসহ ১০ জনেরও বেশি।
কুষ্টিয়ার বিভিন্ন উপজেলাতে আইন অমান্য করে ওভার লোড নিয়ে শহরে বা গ্রামে বেপরোয়া গতিতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে প্রায় ৫০০টি ১০ চাকার ডাম্পার বালুবাহী ট্রাক। তবুও প্রশাসন নিরব। এসব যানের চাকার আঘাতে ক্ষত বিক্ষত হয়ে পড়েছে উপজেলার বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়ক। কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সড়ক এখন ভেঙেচুরে একাকার। ফলে প্রতিদিন এলাকাবাসীসহ ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন, যাত্রী ও পথচারীরা, প্রাণ হারাচ্ছে শিশু থেকে বৃদ্ধ বয়স্ক মানুষ।
কেবল সড়কের ক্ষতি নয়, অহরহ ঘটছে দুর্ঘটনা। বছর শুরুতেই গত কয়েকদিনেই বালুবাহী ট্রাকের চাকায় প্রাণ দিতে হয়েছে নারীসহ ১০ জনেরও বেশি। দন্ডবিধিতে কোন সরকারি সম্পদের ক্ষতি করলে এর শাস্তি বিধান নিশ্চিত করা আছে। ৪৩১ ধারা মোতাবেক সরকারি রাস্তার ক্ষতি সাধন দন্ডনীয় অপরাধ। এ অপরাধের জন্য দায়ি ব্যক্তি পাঁচ বছর পর্যন্ত সশ্রম বা বিনাশ্রম জেলসহ অর্থদন্ডে দন্ডিত হবে। অথচ রহস্যজনক কারণে প্রশাসন ও পুলিশ কেন নীরব।
প্রশাসন কেন নীরব ! এ বিষয়ে বেশ কয়েকজন পোড় খাওয়া ত্যাগী নেতারা বলেন, কুষ্টিয়ার বালুমহাল চালাচ্ছেন যারা, তারা সকলেই ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের ইশারায় বালি ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিনিময়ে ঐসকল ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা প্রতিদিন ক্যাটাগরি অনুযায়ী পাচ্ছেন বান্ডিল। সে কারণেই বালি ব্যবসায়ীরা কাউকে তোয়াক্কা না করে বালিভর্তি ড্রাম ট্রাকের ড্রাইভিং সিটে অধ্যক্ষ চালকদেরকে বসিয়ে প্রতিনিয়ত কেড়ে নিচ্ছে তরতাজা প্রাণ। কুষ্টিয়া এখন তৈরি হয়েছে মৃত্যুপুরীতে।
কুষ্টিয়া জেলায় মোট ২১টি বালুমহাল আছে। এরমধ্যে জুগিয়া বালুমহালটি থেকে সবচাইতে বেশি বালি উত্তোলিত হয় এবং বিক্রি হয়। এই বালি মহলটি কুষ্টিয়া শহরের ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে। জুগিয়া- ভাটাপাড়া সড়ক গত ৫ বছরে দুবার পুননির্মাণ করা হয়েছে। অতিরিক্ত ভার নিয়ে ট্রাক চলাচলের কারণে সড়কটি এখন বেহাল দশায় পরিণত হয়েছে।
এ সড়কে চলা ট্রাকের বেশির ভাগই কুষ্টিয়া পৌরসভার ১৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মহিদুল ইসলাম ও তার স্বজনদের। এ কারনে ভয়ে কেউ মখ খুলতে পারে না। এ দুটি বালুমহাল থেকে প্রতিদিন অন্তত ৫০০ থেকে ৭০০ গাড়ি বালু জেলার বিভিন্ন গন্তব্যে যাচ্ছে। ১০ চাকার ডাম্পার বালুবাহী ট্রাক নামছে নদীর তীরে। প্রতিটি ১০ চাকার ট্রাক বা ডাম্পার বহন করছে অন্তত ৪৫-৫০ মেট্রিক টন বালু। ছয় চাকার ডাম্পার বহন করছে ২৫-৩০ টন। পাঁচ টন বহন ক্ষমতার ট্রাকে বালু যাচ্ছে ১১-১৪ টন। আর অনভিজ্ঞ চালকরাই এই বালিবাহী গাড়িগুলো চাল চালাচ্ছেন তাদের নেই কোন ড্রাইভিং লাইসেন্স অধিকাংশ ড্রাম ট্রাক গুলো চালাচ্ছে হেলপার দিয়ে।
কুষ্টিয়ার সুধীমহলরা প্রশাসনের দৃষ্টি গোচর করে বলেন, প্রাণহানি থেকে রক্ষা পেতে উক্ত বালি ভর্তি ড্রাম ট্রাক গুলিকে দিনে চলাচল বন্ধ রেখে রাত্রে একটি নির্দিষ্ট টাইম বেঁধে দেয়া হোক। তাহলে প্রাণহানির সংখ্যাটি অনেকাংশে কমে যাবে। নইলে আরো প্রাণহানির ঘটনা ঘটতে পারে। তারা এটাও বলেন, একটি জীবনের মূল্য যে কতখানি তা উক্ত ড্রাম ট্রাক চালকরা জানেনা। তারা মাতাল অবস্থায় বেপরোয়া গতিতে ছুটতে থাকে। ট্রাকের চাকায় কে পিষ্ট হল আর কে হলো না এটা নিয়ে তাদের মাথা ব্যথা নেই।
সরেজমিনে উপজেলা সদরের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, প্রশাসন-পুলিশ সদস্যদের সামনে দিয়ে অবাধে চলাচল করছে বালুবাহী ডাম্পার ট্রাক। কিন্তু এসব যানবাহনের বিরুদ্ধে কোন আইন প্রয়োগ না করে শুধু মোটরসাইকেল ধরপাকড় করছে সংশ্লিষ্টরা।
ওভার লোড বহন ও অবৈধ যানবাহন পরিচালনার বিষয়ে বক্তব্য গ্রহনের জন্য বালুমহালের ইজারাদার মহিদুল ইসলাম এর সাথে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেন নাই। সড়কের ক্ষতির বিষয়ে জানতে চাইলে সড়ক ও জনপথ বিভাগ কুষ্টিয়ার নির্বাহী প্রকৌশলী শাকিরুল ইসলাম বলেন, সড়ক নষ্টের অন্যতম কারণ ওভার লোড বহন। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে তারা একাধিকবার জানিয়েছেন। বিআরটিএ কুষ্টিয়ার সার্কেলের সহকারী পরিচালক এটিএম জালাল উদ্দিন বলেন, ওভার লোড বহন ও অবৈধ যানবাহনের বিরুদ্ধে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।